কাউনঃ শুধুমাত্র শস্য নয়, ফিরে আসা এক জাতিস্মৃতি
যেখানে শহরের ব্যস্ততায় হারিয়ে যায় অতীত, সেখানেই ফিরে আসে মাটির গন্ধে ভরা, মানুষের ঘামে ভেজা কিছু গল্প। তেমনি এক প্রাচীন শস্য, যাকে একসময় বাংলার মাটি চিনত, জানত এবং ভালবাসত। এমন এক সময় ছিল, যখন কৃষকরা মাটিকে কেবল জমি হিসেবে দেখতেন না; তারা ভাবতেন, এটি তাঁদের একান্ত আপন, মাতৃতুল্য। আর সেই মাতৃতুল্য শস্যের নাম ছিল ‘কাউন’ – একটি ক্ষুদ্র দানার মতো, যা একটুখানি পানি ও বাতাস পেলেই বেড়ে উঠত। এটি বাংলার খাদ্য-সংস্কৃতির এক চুপচাপ অথচ অমূল্য অধ্যায়। এক সময়, যখন গ্রামের কৃষক পতিত জমির দিকে তাকিয়ে চিন্তিত হতেন, তখনই কাউনের দানা হয়ে উঠত তাঁদের আশার প্রতীক।
হারিয়ে যাওয়া এক শস্যের গল্পঃ
ধানের মতো দেখতে হলেও, কাউনের রয়েছে নিজস্ব গর্ব এবং এক অনন্য পরিচয়। ধানের তুলনায় স্বভাব, চরিত্র এবং পুষ্টিগুণে এটি সম্পূর্ণ ভিন্ন। যদিও এটি ক্ষুদ্রাকৃতির, কিন্তু (ওয়েবসাইটে কিন্তু বানানটা ভেঙ্গে গেছে) পুষ্টির দিক থেকে এটি এক অমূল্য সম্পদ – গ্লুটেন মুক্ত (ওয়েবসাইটে গ্লুটেন মুক্ত বানানটা ভেঙ্গে গেছে), ফাইবারে ভরপুর, এবং প্রাকৃতিক আয়রন ও প্রোটিনের একটি শক্তিশালী ও নির্ভরযোগ্য উৎস। এই ছোট ছোট দানাগুলোর জীবন শুরু হয়েছিল বহু শতাব্দী আগে, এশিয়া ও আফ্রিকার শুষ্ক প্রান্তরে, এবং পরে বাংলার কৃষকের হৃদয়ে ঠাঁই পেয়েছিল। এটি ছিল সেই শস্য – যা কম যত্নে, পতিত জমিতে, মাত্র তিন মাসে ফলন দিত, না বলা এক প্রতিশ্রুতির ((ওয়েবসাইটে প্রতিশ্রুতির বানানটা ভেঙ্গে গেছে) মতো। কৃষকের কষ্টের দিনে এটি আশার আলো হয়ে উঠত।
হারিয়ে যাওয়ার কারণঃ
সময় বদলেছে। শহরের আলো বেড়েছে, বিদেশি শস্যের বাজার দখলের প্রতিযোগিতা চলছে, বেড়েছে উচ্চমূল্যের প্যাকেটজাত খাবারের সমাহার, বিজ্ঞাপন। এই সবকিছু আমাদের দৈনন্দিন খাবারকে পরিণত করেছে ফ্যাশনে। এই দৌড়ে, অভিমানী কাউন নীরবে পিছিয়ে পড়েছে। এসবের ভিড়ে, কাউনের নাম যেন কালের সাক্ষী হয়ে কেবল ইতিহাসের পাতায় রয়ে গেছে।
ফিরে দেখাঃ যখন শস্য খুঁজি, ইতিহাস জেগে ওঠে
তবুও কিছু কিছু জিনিস মাটি থেকে মুছে যায় না। তারা থাকে কৃষকের স্মৃতিতে, রান্নাঘরের কোণে, কিংবা মনের এক গোপন কুঠুরীতে নিত্যদিনকার চাহিদায়। গ্রাসরুটস ইনিশিয়েটিভ ঠিক এই ডাকটাই দিয়েছে। আমাদের প্রোডাক্ট ইনোভেশন টিম রমজানের সময় যখন পুষ্টিকর এবং সহজপাচ্য খাবারের সন্ধানে মাঠে নামে, তখনই কাউনের গল্প আবার শোনা যায়। আমরা জানতাম ও বিশ্বাস করতাম কাউন শুধু আরেকটি শস্য নয়, এক চেতনার পুনরুজ্জীবন। এটি এক সময়ের ‘গরিবের খাবার’ বলে ‘অবজ্ঞায়িত’ ও ভুলে যাওয়া খাবার, অথচ প্রকৃত অর্থে খাদ্যগুনের মান বিচারে এক রাজসিক পুষ্টির ভাণ্ডার।
তাই আমরা পা বাড়ালাম উত্তরবঙ্গে, যেখানে এখনো কাউনের ধান গন্ধ ছড়ায়। আমাদের গন্তব্য ছিল নীলফামারী জেলা, সেখানকার এক প্রত্যন্ত গ্রামে গিয়ে আমরা পরিচিত হলাম জলীল মাতবরের সঙ্গে। বয়সের ভারে তাঁর মাথা কিছুটা ন্যুব্জ হলেও, স্মৃতিতে এখনও জ্বলজ্বল করছে সোনালি কাউনের দিনকাল। “আগে আমি ৩০ বিঘা জমিতে শুধু কাউনই করতাম,” তিনি বললেন, স্মৃতির আভায় ঝলমল হাসি দিয়ে। “এখন ২ বিঘায় করি, নিজেরা খাই, কিছু বাজারে বিক্রি করি।” আমরা তাঁকে শুধু কাউনের জন্য খুঁজিনি, খুঁজেছিলাম এই মাটির গল্পের সাক্ষীর জীবন্ত অধ্যায় হিসেবে। জলীল মাতবরের হাত ধরেই আমাদের যাত্রা শুরু – পুরনো শস্যকে নতুন ভাষায় তুলে ধরার প্রয়াস।
যেখানে গুণগত মানের প্রশ্ন, সেখানে ‘তিতাস’ই শেষ কথাঃ
জলীল মাতবরের হাত ধরে আমরা শিখি – কিভাবে স্থানীয়ভাবে কাউনের ধানকে প্রক্রিয়াজাত করে চালে রূপান্তর করা হয়, এবং কোন পদ্ধতিতে তা রোদে শুকিয়ে, ঝাড়া-পোছা করে সংরক্ষণ করা হয়। এখানে আধুনিক যন্ত্র নয়, বরং অভিজ্ঞতার পরম্পরায় হাতে তৈরি সেই চাল হয়ে ওঠে আমাদের প্রথম ‘বিশুদ্ধ কাউন চাল’। আমরা চেয়েছি অভিজ্ঞতা, স্থানীয় পদ্ধতি এবং মাটির প্রতি ভালোবাসার সমন্বয়ে কাউনের চাল তৈরি করতে। আজ যা শহরবাসীর পাতে পৌঁছায় সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক ও স্বাস্থ্যকর একটি বিকল্প হিসেবে। আমরা বেছে নিয়েছি তিতাস জাতের কাউন, যা নীলফামারী ও গাইবান্ধার উঁচু জমিতে বেড়ে ওঠে মাটির গান শুনে। এই জাতটি দানায় মোটা, পুষ্টিগুণে সমৃদ্ধ এবং সহজে হজমযোগ্য। কালো, লাল, গোল্ডেন ও সাদা জাতের কাউনের মধ্যে ‘তিতাস’ পুষ্টির গুনমানের দিক থেকে সবচেয়ে সমৃদ্ধ এবং আলাদা ও স্বতন্ত্র।
আমরা এখানেই থেমে থাকিনি। জলীল মাতবরের অনুপ্রেরণায় তার এলাকার আরও চাষিরা আমাদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন। তাঁরা জানেন, এই শস্য এখন আর শুধু তাদের এলাকায় সীমাবদ্ধ থাকবে না – এটি পৌঁছাবে শহরের অসংখ্য রান্নাঘরে, নতুন এক পরিচয় ও মর্যাদায়।
আমাদের লক্ষ্যঃ
বিলুপ্তপ্রায় এ শস্যকে ফিরিয়ে আনার প্রয়াসে আমাদের এ যাত্রা। আমাদের প্রচেষ্ঠা অব্যাহত রয়েছে আরও বেশি সংখ্যক কৃষককে এই নেটওয়ার্কে যুক্ত করার, যেন বাংলার প্রতিটি ঘরে পুষ্টিকর খাবার তৈরিতে কাউনের স্থান হয়। এই শস্যকে তার নিজস্ব পরিচয়ে, স্মৃতিতে, এবং শেকড়ে গর্বিত করে ফিরিয়ে আনাটাই আমাদের উদ্দেশ্য। কারণ আমরা বিশ্বাস করি – যা একদিন ভুলে যাওয়া হয়েছিল, সেটাই হয়তো আগামীর সবচেয়ে প্রয়োজনীয় উত্তর। কাউন তাই কেবল খাদ্য নয় – এ এক নীরব বিপ্লব, যার শিকড় আমাদের মাটিতে, আর ভবিষ্যৎ আপনার টেবিলে। কাউন তাই শুধুই শস্যদানা নয় – কৃষকের ঘামে রাঙা, অতীতের বুকে লেখা ভবিষ্যতের গল্প।