তেল নয়, যেন স্মৃতির ফোঁটাঃ
বাগেরহাট জেলার হরিণঘাটা গ্রামের এক কোণে, শতবর্ষী একটি নারিকেল গাছের ছায়ায় বসে আছেন এক ষাটোর্ধ নারী। তার চোখে আছে গভীরতা, হাতে কৌঁশলের স্মৃতি, আর হৃদয়ে প্রজন্ম ধরে বয়ে আনা এক প্রাচীন জ্ঞান – হাতে তৈরি খাঁটি নারিকেল তেলের শুদ্ধতম রূপ। তার চুলে রূপোর রেখা, হাতে সময়ের ছাপ – তবুও তাঁর হাতে এখনো থাকে এক নিখুঁত ছন্দ, ঠিক যেমনটা ছিল তাঁর মায়ের, তাঁর নানীর। এই নারীকেই আমরা পেয়েছি, আমাদের প্রকৃত ‘তৈলশিল্পী’ হিসেবে।
এই নারীর নাম জরিনা খাতুন (ছদ্মনাম)। এক সময় ছিলো তার চারদিকে ভরা উঠোন, নারিকেল গাছের ছায়া, আর কুয়োর জল। এখন তার জীবনের ছায়া একটু দীর্ঘতর, কিন্তু এখনো প্রতিটি সকাল শুরু হয় সেই নারিকেল কুড়োনোর প্রস্তুতি দিয়ে। আর সেই পথ ধরে, শুরু হয় নারিকেল তেল তৈরির এক অনন্য প্রক্রিয়া – যেটা আজ আর সহজে দেখা যায় না।
ইতিহাসের আলোয় হাতে বানানো নারিকেল তেলঃ
বাংলাদেশে হাতে তৈরি নারিকেল তেলের ইতিহাস শত শত বছর পুরোনো। কোনো এককালে, উপকূলীয় অঞ্চলগুলো – বিশেষ করে বাগেরহাট, বরগুনা, পটুয়াখালী – এই তেলের জন্য বিখ্যাত ছিল। শীতের সকালে উঠোনজুড়ে নারিকেল শুকানো, ভাঙা, খোসা ছাড়ানো, শাঁস কোড়ানো, তারপর সেই শাঁস শুকিয়ে গরম করে ঘিয়ে-ঘিয়ে তেল নামানো – এই ছিল এক চক্রাকারে চলা ঘরের কাজ, যা কেবল নারীদের হাতেই সম্পন্ন হতো। সেই সময়কার তেলে কোনো কেমিক্যাল থাকতো না, থাকতো না কোনো ঘ্রাণবর্ধক উপাদান – শুধু থাকতো মাটির গন্ধ, সময়ের ধৈর্য, আর মানুষের মমতা।
জরিনাকে খুঁজে পাওয়ার গল্পঃ
গ্রাসরুট ইনিশিয়েটিভ-এর প্রোডাক্ট ইনোভেশন টিম যখন দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের হারিয়ে যাওয়া খাদ্য ঐতিহ্য পুনরুদ্ধারে বের হয়, তখন তারা চেয়েছিল এমন কাউকে খুঁজে পেতে, যিনি এখনো সেই পুরনো প্রক্রিয়ায় নারিকেল তেল তৈরি করেন। বিভিন্ন গ্রাম ঘুরে, মানুষের মুখে মুখে শোনা গল্প ধরে একদিন তারা পৌঁছে যায় বাগেরহাট জেলার হরিণঘাটা গ্রামে।
সেই গ্রামের মানুষের মুখে ঘুরে বেড়াতো জরিনার নাম। “তাঁর বানানো তেলে এক অদ্ভুত শান্তি আছে,” বলছিলেন গ্রামের একজন প্রবীণ। দলটি যখন তাঁর দরজায় পৌঁছায়, তখন তিনি উঠোনে নারিকেলের শাঁস কোড়াচ্ছিলেন। সেদিনের আলোয় ধরা পড়েছিল এক দৃশ্য – যেখানে সময় থেমে গেছে, এবং থেকে গেছে এক মানুষ। যিনি এখনো বিশ্বাস করেন – ভালো জিনিস বানাতে হলে মেশিন নয়, লাগে মন।
কেন শুধুমাত্র নির্দিষ্ট বাগানের নারিকেল?
জরিনা খাতুন আজও নারিকেল তেল বানান। তিনি কোনো চাপ নেন না, ব্যবসায়ের কোনো নিয়ম মানেন না – তেল বানান নিজের খেয়ালে। তবে একটি শর্তে – তিনি শুধু হরিণঘাটা গ্রামের… পাশের পুরোনো নারিকেল বাগানের ফল ব্যবহার করেন। কারণ, তার মতে, ঐ নারিকেলগুলোর ভেতরের পানি একটু মিষ্টি, শাঁসটা একটু ঘন। এবং তাঁর ভাষায়, “এই নারিকেল দিয়ে বানানো তেলের ঘ্রাণ যেন নিজের মায়ের কোলের মতো।”
তিনি বলেন, “অন্য জায়গার নারিকেলে তেল হয় বটে, কিন্তু মন মাতে না। তেলে এক ধরনের তিক্ততা থাকে। এই গাছগুলোর নারিকেলেই আমি আমার মাকে খুঁজে পাই।”
সীমিত প্রযোজনা, অপরিসীম মায়াঃ
এই আবেগী ভালোবাসা আর গভীর অভ্যস্ততায় জরিনা খাতুন বছরে মাত্র কিছু নির্দিষ্ট পরিমাণ তেল তৈরি করেন। সেটা মজুদ করা হয় শুধুমাত্র গ্রাসরুট ইনিশিয়েটিভ-এর জন্য। কারণ তার বিশ্বাস, “যার জন্য বানাবো, সে যেন বুঝতে পারে – তেলটা শুধু ব্যবহারের জন্য না, এটা একটা মায়ার ফোঁটা।”
এই তেল বোতলে ভরা নয়, স্মৃতিতে ভরা। এই তেল শুধু রান্নায় গন্ধ ছড়ায় না, ছড়ায় ইতিহাস। এ যেন একটি সময়ের দলিল – যেখানে নারী, প্রকৃতি, আর যত্ন একত্র হয়ে রচনা করেছে এক অনন্য ঐতিহ্য।