কাসুন্দি

কাসুন্দির গল্পএটি শুধুই খাদ্য নয়, একই সাথে সংস্কার, সাধনা, এবং উত্তরাধিকারঃ 
প্রাচীন কোনো পূর্ণিমা রাতে হয়তো প্রথম আগুন জ্বলে উঠেছিল একটি মাটির চুলায়। পাশে বসে ছিলেন এক নারী – মনোযোগে, নিঃশব্দে, হাতে ছিল বাঁশের চামচ। শাড়ির আঁচল সরিয়ে অনবরত নাড়ছিলেন সরিষা, জিরা, আদা আর রোদে শুকানো শুকনো মরিচের মিশ্রণে ফুটতে থাকা জল। তখনও জানতেন না, তিনি আসলে শুরু করে দিয়েছেন এক নিবিড় সাধনা…যার নাম কাসুন্দি। এটা এক নিখুঁত ঐতিহ্যের পদচিহ্ন। কাসুন্দি তৈরি কেবল রান্নার একটি প্রক্রিয়া নয় বরং এক ধরনের আধ্যাত্মিক অনুশীলন, জীবন-দর্শনের এক বহিঃপ্রকাশ।

ঐতিহ্যের ভিতরেই বিশুদ্ধতাঃ
পাবনার বেড়া উপজেলার নিভৃত এক গ্রাম, এখানে সময় যেন একটু ধীরলয়ে চলছে। নানা সূত্র আর মানুষের মুখে মুখে ছড়ানো গল্পে আমরা এই গ্রামের সন্ধান পাই যেখানকার নারীরা যুগের পর যুগ ধরে কাসুন্দি তৈরি করেন। যার গন্ধ, রং, স্বাদের পেছনে রয়েছে ইতিহাস, আর রয়েছে আধ্যাত্মিকতা। বই-পুস্তকে লেখা না থাকলেও মা থেকে মেয়ে, শাশুড়ি থেকে পুত্রবধূ…এভাবেই এই কাসুন্দি তৈরির গুপ্তবিদ্যা তারা ধরে রেখেছে। যেখানে নারীদের হাতের ছোঁয়ায় লেখা আছে কাসুন্দি প্রস্তুতির নিয়ম। এই কাসুন্দি শুধু খাবার নয়, সম্পর্কেরও বাহক। আমের মৌসুমে কাঁচা আমের সঙ্গে মেয়ের বাড়িতে কাসুন্দি পাঠানো এখানকার এক মধুর ঐতিহ্য। গ্রামটির নারীরা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে এক গোপন প্রক্রিয়ায় তৈরি করে চলেছেন শুধুমাত্র একটি চাটনি নয়, বরং এক অনন্য স্মৃতি।

কাসুন্দি তৈরির পরম্পরা সাধনাঃ
অনিতা রানী, এই গ্রামেরই একজন নারী, যিনি বছরের নির্দিষ্ট সময়েই শুরু করেন কাসুন্দি তৈরির সাধনা – বৈশাখের প্রথম পূর্ণিমার পর পরই, যখন প্রকৃতি নিজের মতো করে পবিত্র হয়। শাশুড়ি তাকে শিখিয়েছেন, কাসুন্দি শুধু খাবার নয়, এটি এক ধরনের পবিত্র অনুশীলন। তাই পরিশুদ্ধ ও পরিপাটি মনে, পরিচ্ছন্ন দেহে, পরম নিষ্ঠা ও একাগ্রতার সাথে তিনি এই কাজ শুরু করেন। এটা পবিত্রতার মাধ্যমে শুরু হয়, আর নিষ্ঠায় হয় পরিণতি। আমাদের প্রোডাক্ট ইনোভেশন টিম এই গ্রামে অবস্থান করে কাসুন্দি তৈরির পুরো প্রক্রিয়া পর্যবেক্ষণ করে। অনিতা রানীর ভাষায় – “এইটা একটা পবিত্র কাজ, পয়-পরিস্কার না হয়ে এটা তৈরি করা যায় না।”

মসলা সংগ্রহঃ প্রকৃতির সাথে পুনর্মিলন 
বাস্তবে এই অনুপম শিল্পকর্ম শুরু হয় মসলা সংগ্রহের অনুশীলন দিয়ে। কাসুন্দির হৃদয় তার মসলা। এই গ্রামের অনিতা রানীরা বছরের নির্দিষ্ট সময়ের অপেক্ষায় থাকেন, যখন বাজারের শুকানো মসলাগুলো সেরা রূপে থাকে। নিজ হাতে সংগ্রহ করেন রাই সরিষা, যার ঝাঁজ আর ঘ্রাণ অসাধারন! এরপর ছোট ও বড় দানার ধনিয়া, জয়ন, জিরা, তেজপাতা, মৌরী, আদা, হলুদ, মরিচ আরো নানা পদের মসলা এবং সরিষার নির্দিষ্ট অনুপাতের ‘গোপন মিশ্রণ’ তৈরি করেন। এগুলো ধুয়ে, পরিষ্কার করে, সূর্যের আঁচে ২-৩ দিন ধরে শুকান এবং ঢেঁকিতে মসলা গুড়া করেন। ঢেঁকির অভিঘাতে প্রকাশ পায় মসলার নিদ্রিত চরিত্র – ঝাঁজ, রং ও রস মিলিয়ে বের হয় এক সুরভিত ইতিহাস, অন্যদিকে তাদের চোখে থাকে নির্মল আনন্দের দীপ্তি। যেখানে প্রতিটি শব্দ একেকটি ছন্দ, প্রতিটি গন্ধ একেকটি প্রাচীন স্মৃতি।

জলের সাধনাঃ ইছামতির হৃদয় ছুঁয়ে আনা পবিত্রতা
মসলার প্রস্তুতির পরে শুরু হয় আরেকটি মহার্ঘ ধাপ – বিশুদ্ধ পানি সংগ্রহ। অনিতা রানী এবং তার পুত্রবধু হাঁটেন মাইলের পর মাইল, কাঁখে কলসি তুলে যান ইছামতি নদীতে জল আনতে। জল এখানে কেবল উপাদান নয়, এটি আত্মা। নদীর জল সারারাত স্থির রাখা হয়, পরদিন নিখুঁত মনোযোগে ছেঁকে নেওয়া হয় যেন এক ফোঁটাও অশুদ্ধতা না থাকে। পরদিন ভোর, যখন গ্রামের আকাশে লাল আভা ছড়িয়ে পড়ে, তখন শুরু হয় জল সাধনা। বাড়ির আঙিনায় প্রস্তুত রাখা বিশাল লোহার হাঁড়ির নিচে জ্বলে ওঠে শুকনো লাকড়ির আগুন। হাঁড়ি ভর্তি জল আস্তে আস্তে ফুটতে শুরু করে। ঘন্টার পর ঘন্টা ধরে লাকড়ি জ্বলতে থাকে। এসময় খেয়াল রাখা হয় আগুন যেন কোনোভাবেই না নিভে। কারন একবার নিভলে জলের রূপ-গতি নষ্ট হয়ে যাবে, কাসুন্দি ভালো হবে না। ধীরে ধীরে বদলে যেতে থাকে পানির রং…হালকা নীলাভ রং মিলিয়ে গিয়ে এক রকম গাঢ় স্বর্ণালী আভা ধরে…যেন সূর্যাস্তের আগের গাঢ় আলো জলের হাঁড়িতে ঢেলে দেওয়া হয়েছে। এই ঘন জলের কোমল দীপ্তি, তার ধীর গতি, তার উষ্ণ সুবাস যেন ডাক দেয় অতীতের কোনো হারানো সকালের দিকে – এই মধুর জলই কাসুন্দির প্রাণ। লাল আভায় ভরা প্রভাত, লাকড়ির ধোঁয়ায় ফুটন্ত হাঁড়ি, জল যখন বদলে যায় সোনালি আভায় – তখন তার মধ্যেই তৈরি হয় কাসুন্দির প্রাণতত্ত্ব। এই পুরো সময় অনিতা রানী উপবাসে থাকেন – শুদ্ধতার ব্রত নিয়ে, যেন তার দেহ-মন-পাত্র সব পবিত্র থাকে। এ সবই যেন এক আধ্যাত্মিক সাধনার অংশ।

পরিশ্রম, ধৈর্য প্রার্থনার এক পরাকাষ্ঠাঃ
এরপর এই জলে ঢেঁকিতে গুড়া করা মসলা মেশানো হয় এবং শুরু হয় আবারও এক দীর্ঘ প্রক্রিয়া – বাঁশ ও নারিকেলের মালায় তৈরি বিশেষ চামচ দিয়ে অনবরত নাড়তে থাকেন অনিতা রানী। হাত ধরে আসে ও ব্যথা করে, কাঁধ জমে যায়, তবুও হাত থামে না। এই ধৈর্যের মন্দিরেই জন্ম নেয় এক অনন্য স্বাদের শিল্পকর্ম তথা তৈরি হতে থাকে কাসুন্দির আরেকটি ধাপ! এরপর ঐ পানিতে দেওয়া হয় শিলপাটায় বাটা আদা ও গরম মসলা। শেষপর্যন্ত, ঘন্টার পর ঘন্টার শ্রম ও ভালোবাসার মিশ্রণে কাসুন্দি হয় সম্পূর্ণ। কিন্তু এখানেই শেষ নয়-এখনো আছে রোদের আরাধনা। আরও দুইদিন টানা ঝলমলে রোদের নিচে বসিয়ে রাখা হয় কাসুন্দিকে, যেখানে প্রকৃতি নিজ হাতে তার পূর্ণতা দেয়।

এটা শুধুই কাসুন্দি নয়, একটি স্মৃতি, একটি চেতনাঃ
অনিতা রানী বলেন, “এই কাসুন্দি ফ্রিজ ছাড়াই ছয় মাস পর্যন্ত সংরক্ষণ করা যাবে, নষ্ট হবে না।” কারণ এতে নেই কোনো কৃত্রিম উপাদান – রয়েছে প্রকৃতি, শুদ্ধতা, সাধনা, সময় এবং ভালোবাসার এক অপূর্ব মিশ্রন। যখন আপনি এটি চেখে দেখবেন কাঁচা আম, পেয়ারা বা আনারসের সাথে – আপনার মনে হবে ফিরে গেছি সেই পুরনো দুপুরে, যেখানে দাদী/নানী হাতে তুলে দিচ্ছেন কাসুন্দি মাখা ফল।

আমাদের এই প্রচেষ্টা পুরোপুরি – অর্গানিক ও রাসায়নিকমুক্ত; প্রাকৃতিক ও পরিবেশ-বান্ধব; আধ্যাত্মিক মূল্যবোধে ভরপুর; ঐতিহ্য ও সময়ের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ; গ্রামীণ নারীদের অন্তর্নিহিত শক্তি উন্মোচন।

এখন আপনার পালাঃ
চেখে দেখুন আমাদের কাসুন্দি। খুঁজে নিন সেই হারানো দুপুরের ঘ্রাণ। নিজের শরীরকে দিন বিশুদ্ধ খাবার, আর মনের ভিতর জাগিয়ে তুলুন পরম্পরার এক আত্মিক আলোর সুখানুভূতি। আপনি যখন এই কাসুন্দির স্বাদ নেবেন, আপনার জিভে শুধু ঝাঁজ নয় – আপনার হৃদয়ে আসবে এক নিরব আবেগ, চোখে ভেসে উঠবে আপন শৈশব।

আমরা শুধু কাসুন্দি বিক্রি করি না, আমরা আপনাকে উপহার দিই – একটি সময়ের গল্প, এক প্রজন্মের সংস্কার, নারীশক্তির নিঃশব্দ আরাধনা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *