ব্ল্যাক রাইস

ধানঃ প্রকৃতির অনবদ্য সৃষ্টি, বৈচিত্র্যের এক মহাকাব্য
বিশ্বের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে রয়েছে লাখো প্রজাতির ধান – কোনোটি খরা সহনশীল, কোনোটি লবণাক্ত মাটিতেও ফলে অনায়াসে। কোথাও তার রঙ নরম সোনালি, কোথাও বা রক্তিম লাল। একেক মাটির ধরন, জলবায়ু, উচ্চতা আর মানুষের যত্নে তার রূপ ও স্বাদ বদলে যায় – কখনও হালকা সুগন্ধে, কখনও গভীর পুষ্টিতে।

এই বৈচিত্র্যের মাঝেই জন্ম নিয়েছে হাজারো দেশীয় ধানের জাত – প্রতিটি জাত যেন একেকটি অঞ্চলের গল্প, সংস্কৃতি আর ইতিহাসের জীবন্ত স্মারক। এ এক সজীব সংগ্রহশালা, যেখানে প্রতিটি ধানের দানা শুধু খাদ্য নয়, বরং মাটির মমতা ও মানুষের অধ্যবসায়ের মিলিত ফসল।

নিষিদ্ধ চালের নবজন্মঃ
বিশ্বে প্রাচীন জাতের ধানের মধ্যে ব্ল্যাক রাইস প্রধানতম। একসময় এই চালের নাম ছিল ‘নিষিদ্ধ’ চাল। চীনের প্রাচীন রাজদরবারে এই কালো চাল শুধুমাত্র রাজপরিবারের জন্য সংরক্ষিত থাকত। যাকে চীনারা ভাবত দেহে প্রাণের দীপ্তি ফেরায়, যৌবন ধরে রাখে, এমনকি সন্তান ধারণ ক্ষমতাও বাড়ায়। একে তাই রাখা হতো শুধুমাত্র রাজপরিবারের জন্য। প্রজারা চাইলে পেত না, আর তাদের কাছে পেলে তা হতো গুরুতর শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এই চাল শুধু খাদ্য নয়, ছিল একপ্রকার রাজসিক ওষুধ। একে ঘিরে ছিল আভিজাত্য, রহস্য আর দীর্ঘায়ুর প্রতিশ্রুতি। বলা হতো, এতে আছে দীর্ঘায়ুর গোপন রহস্য, আর কামনা ও জীবনীশক্তির অমোঘ প্রেরণা। সাধারণ মানুষের এ চাল খাওয়ার অধিকার ছিল না – তাই নাম তার ‘Forbidden Rice’। কিন্তু কে ভেবেছিল, এই নিষিদ্ধ খাদ্যের গল্প একদিন এসে মিশবে বাংলাদেশের নওগাঁ জেলার কোনো কৃষকের হাতের মাটিমাখা ঘ্রাণে! আর সেখান থেকে গ্রাসরুটস ইনিশিয়েটিভ সেই মাটিমাখা ঘ্রাণের ব্ল্যাক রাইস তুলে দিচ্ছে আপনার খাবার টেবিলে।

গ্রাসরুট ইনিশিয়েটিভ-এর প্রোডাক্ট ইনোভেশন টিম যখন হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্যগত খাদ্যশস্যের খোঁজে নেমে পড়ে, তখন তারা জানতে পারে এই প্রাচীন নিষিদ্ধ চালের কথা। এই চালের বিশেষত্ব শুধু তার গভীর বেগুনি রঙেই নয় – তার ধানের পাতা কখনো সবুজ, কখনো গাঢ় বেগুনি রঙের হয়ে ফসলের মাঠে এক অদ্ভুত নান্দনিকতা সৃষ্টি করে। এসব মাঠ দূর থেকে দেখলে মনে হয় যেন আঁকা হয়েছে এক প্রাকৃতিক ক্যানভাস – যেখানে রঙ, গন্ধ, ইতিহাস আর সুস্বাদু সম্ভাবনার মিশেল।

এর ভাত হয় আঠালো, হালকা সুগন্ধি। পায়েস, খিচুড়ি, ঘি-ভাত, এমনকি পাস্তা, নুডলস বা পাঁপড় – সবখানেই এর রং ও স্বাদ যোগ করে এক অভিনব অভিজ্ঞতা। ফলে এটি শুধু একটি চাল নয়, এটি হয়ে উঠেছে একধরনের অভিজাত খাদ্যপণ্য – যা পুষ্টিগুণে ভরপুর, হৃদয়কে শীতল করে, স্মৃতিকে জাগিয়ে তোলে।

থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন, ভারত, জাপান, চীন ও ভিয়েতনাম – এই সাতটি দেশ থেকে সংগৃহীত বেগুনি ও সবুজ পাতার ব্ল্যাক রাইস জাত বর্তমানে চাষ হচ্ছে বাংলাদেশে। এর অনেকটাই সম্ভব হয়েছে কৃষি উদ্ভাবক ড. মেহেদী মাসুদের উদ্যোগে। ২০১৯ সালে, ড. মাসুদ ইন্দোনেশিয়ার বালি দ্বীপ থেকে ব্লাক রাইসের একটি বারোমাসি জাত সংগ্রহ করে দেশে আনেন। তারপর থেকে প্রধানত কুমিল্লা ও নওগাঁ জেলার কিছু কৃষক এটির চাষ শুরু করেন। আমাদের প্রোডাক্ট ইনোভেশন টিম বিশেষজ্ঞদের সাথে পরামর্শ করে জানতে পারে, ব্ল্যাক রাইস বাংলাদেশের কিছু অঞ্চলে চাষ হলেও নওগাঁর জলবায়ুতে চাষযোগ্য ব্ল্যাক রাইস উচ্চমানের, যার সুগন্ধ ও স্বাদ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সেরা জাতগুলোর মতোই সমৃদ্ধ।

আমাদের প্রোডাক্ট ইনোভেশন টিম পৌঁছে নওগাঁর তীব্র রোদ, ধুলোমাখা মাঠ ও লালচে মাটির মাঝে। বহু ঘুরে, বহু কৃষকের সঙ্গে কথা বলে তারা খুঁজে পান সেই অভিজ্ঞ, নিষ্ঠাবান কৃষকের দলকে, যারা ড. মেহেদী মাসুদের প্রকল্পে যুক্ত ছিলেন এবং নিজেদের হাতেই গড়ে তুলেছেন ব্ল্যাক রাইস চাষের একটি নির্ভরযোগ্য নেটওয়ার্ক। এই নেটওয়ার্ক এখন শুধুমাত্র চাষ নয়, সংরক্ষণ, শুকানো এবং গ্রামীণ কায়দায় প্রক্রিয়াজাতকরণের কাজও করে – যার মাধ্যমে চালের আকার, গন্ধ, রং ও পুষ্টিগুণ অটুট থাকে।

ব্ল্যাক রাইসঃ রাজসিক ঐতিহ্যের ঘ্রাণে ভেজা প্রতিটি দানা
গ্রাসরুট ইনিশিয়েটিভ এখন সেই ব্ল্যাক রাইস’কে সযত্নে সংগ্রহ করে নতুন করে তুলে এনেছে – শুধুই একটি প্রিমিয়াম পণ্যের মতো নয়, বরং ইতিহাসের এক গভীর পুনর্জন্মের মতো। এক সময় যেটি ছিল রাজাদের অনার্য ভোজের গোপন অহংকার, আজ সেটিই সযত্নে পৌঁছে যাচ্ছে সাধারণ মানুষের ঘরে – ঠিক সেই অভিজাত ঘ্রাণ, ঐতিহ্যের শিকড় আর ভালোবাসার আবেগে গড়া এক অনুপম স্বাদ নিয়ে।

এই চাল রান্না মানে শুধু পেট ভরানো নয় – এটা এক অভিজ্ঞতা, যা আপনাকে নিয়ে যায় শিকড়ের কাছে, স্মৃতির অতলে, আর ইতিহাসের নরম আলোয়। এটা স্মৃতি ও সংস্কৃতির সান্নিধ্যে আসার গল্পও বটে।

এর প্রতিটি দানার মধ্যে যেন লুকিয়ে আছে এক নিষিদ্ধ ঐতিহ্যের গন্ধ, এক প্রাচীন সভ্যতার ছোঁয়া, আর এক নবজাগরণের গল্প – যেটা বলে যায়, পুরোনো সবই পুরোনো নয়।

এটি শুধু খাদ্য নয়
এটা শ্রদ্ধা, স্মৃতি, আর সংস্কৃতির সঙ্গে সংলাপ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *