বেসন

এক অভাব, এক উপলব্ধিঃ
গ্রাসরুট ইনিশিয়েটিভ-এর এই যাত্রা শুরু হয়েছিল এক পবিত্র উপলক্ষকে ঘিরে – রমজানের আগমনী বার্তা যখন বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছিল, ঠিক তখনই আমাদের চোখে পড়ে এক গভীর বাস্তবতা। সে সময় যখন চারপাশ জেগে উঠছিল এক পরিশুদ্ধ প্রস্তুতির ব্যস্ততায়, ঠিক তখনই সে আনন্দের আবহেই আমরা টের পেলাম এক গভীর শূন্যতা – বাজারে বেসন আছে ঠিকই, কিন্তু স্বাদে নেই সেই চিরচেনা অন্তরস্পর্শ। স্বাদ যেন কৃত্রিম, প্রাণ নেই; গন্ধ যেন ফ্যাকাসে; আর পুষ্টিগুণ যেন বিজ্ঞাপনের শব্দমাত্র। এই বেসন কি সেইটা, যেটা দিয়ে মা বানাতেন গরম পাকোড়া? যেটা মুখে দিলেই বোঝা যেত, এটি শুধু খাবার নয় – একটি ঘরোয়া রন্ধনশিল্প?

স্বাদের অন্তস্থলে এক অতৃপ্তিঃ
রমজান যতই এগিয়ে আসছিল, ভোক্তাদের মধ্যে ততই বাড়ছিল এক নিঃশব্দ চাহিদা – নিখুঁত গুনগতমানের বেসনের আকুলতা। কিন্তু বাজারে যেসব বেসন পাওয়া যাচ্ছিলো সেগুলোর কোনোটিতে ছিল কাঁচামালের ঘাটতি, কোনোটিতে উপকরণের অনুপাতে গরমিল – স্বাদ আর গুণমানেও ছিল না সেই পরিপূর্ণতা, যা একজন রন্ধনশিল্পীর স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে পারে।

বাজার নয়, মাটির কাছেই উত্তর খুঁজে পেলামঃ
এই অভাব থেকেই জন্ম নেয় এক সাহসী সিদ্ধান্ত! আমাদের প্রোডাক্ট ইনোভেশন টিম নেমে পড়ে বেসনের খোঁজে – না, শুধু বাজারের বেসন নয়, আদর্শ বেসনের সন্ধানে।

গবেষণার পথে বাজার ঘুরে আমরা আবিষ্কার করলাম ৩ টি মূলধারা

১. শুধু ছোলাবাটা বেসন
২. শুধু অ্যাংকরবাটা বেসন
৩. ছোলা, মুগ ও অন্যান্য ডালের অজানা ও নিষ্প্রাণ সংমিশ্রণে তৈরী বেসন।

কিন্তু তাতেও নেই সেই ভারসাম্য, যা সুগন্ধ, স্বাদ, আর পুষ্টির সত্যিকারের মিলন ঘটায়। বাজার ভর্তি বেসন আছে ঠিকই কিন্তু তার স্বাদে নেই প্রাণ, গন্ধে নেই দেশ, আর গুণমানে নেই মমতা। তাতে নেই সেই ঘ্রান, যা রান্না ঘরের পেছনের কবিতা হয়ে উঠে। তখন প্রশ্ন জাগলো – বেসনের সংজ্ঞা কি হারিয়ে গেছে, আদর্শ বেসন কি আদৌ সম্ভব? তখন আমরা বুঝলাম, এখানে প্রয়োজন শুধুমাত্র একটি পণ্য তৈরি করা নয় – প্রয়োজন, হাতে তৈরী আদর্শ অনুপাতের এক মানসম্মত বেসন তৈরি করা। আমরা নির্ধারণ করলাম, আদর্শ বেসন হতে হবে ঐতিহ্য আর বিজ্ঞান – দুইয়ের অপূর্ব সম্মিলনে। নির্ভর করতে হবে মাটির স্বাদে, গুণমানের সত্যতায়।

স্বপ্নের সহযাত্রীঃ এক রন্ধনশিল্পী, এক শিল্প, এক মন্ত্র
আমরা তখন অসহায়ের মতো হাত বাড়ালাম এমন একজনের দিকে, যিনি শুধুমাত্র রান্না করেন না – রান্নাকে জীবনের ভাষা হিসেবে গ্রহণ করেছেন। যিনি প্রতিটি ডালের নাম মুখস্থ বলেন না, তাদের গল্প বলেন। আমরা তাকে ভালোবেসে বলি মাসুদ তালুকদার (ছদ্মনাম)। যখন আমরা তাঁকে আমাদের স্বপ্ন আর উদ্দেশ্যের কথা জানাই, তিনি কেবল সহানুভূতির হাত বাড়িয়ে দেন না – তিনি আমাদের সহযাত্রী হয়ে উঠেন। তিনি জানালেন, “বেসন শুধু একটি উপকরণ নয় – এটি একটি অনুভব, একটি নীরব ভিত্তি, যেখান থেকে তৈরি হয় রান্নার জাদু।”

তিনি আমাদের শেখালেন, আদর্শ বেসনের মূলমন্ত্র লুকিয়ে আছে তিনটি উপাদানে
১. দেশি ছোলা – যা, মাটির শরীর
২. দেশি মশুর ডাল – যা, প্রাণের রস
৩. সুগন্ধী আতপ চাল – যা, আত্মার ঘ্রাণ

শুধু উপাদান নয়, এই তিনের এক নিখুঁত অনুপাতের সংমিশ্রণই গড়ে তোলে সেই স্বপ্নের বেসন। মাসুদ তালুকদার নিজ হাতে আমাদের দেখিয়ে দেন, কীভাবে বানাতে হবে সেই বেসন, যা প্রতিটি রন্ধনশিল্পীর রেসিপিতে প্রাণ যোগাবে।

প্রস্তুতপ্রণালীঃ শুধু প্রক্রিয়া নয়, হৃদয়ের নিবিষ্টতায় গড়ে ওঠা এক সাধনার রূপ
এই বেসনের প্রস্তুতপ্রণালী কোনো ফ্যাক্টরির ছাঁচে ধরা-বাঁধা নয়। এটি প্রার্থনার মতো ধৈর্য ও পরিশ্রমের কাজ। প্রথমে আমরা দেশি ছোলা, মশুর আর আতপ চালকে আলাদা আলাদা ভাবে ভিজিয়ে রাখি সুনির্দিষ্ট সময় ধরে – যাতে ঘুম ভাঙে তাদের প্রাকৃতিক চরিত্রের। তারপর রোদে শুকানোর অধ্যায় – সকাল থেকে বিকেল – বাতাসে, আলোর মধ্যে নিজেকে খুঁজে নেয় প্রতিটি দানা। এরপর ধীরে ধীরে পেষা; না, কোনো অটোমেটেড মেশিনে নয় – বসে বসে পাথরের চক্রে পেষা, ঠিক যেমন সেই পুরনো দিনের কলচাক্কায় তেল বের হতো – অভিমানে নয়, ভালোবাসায়। যার প্রতিটি দানায় আছে প্রকৃতির ছোঁয়া, স্বাদের প্রতিশ্রুতি, আর মানবিক যত্ন।

জন্মঃ একটি স্বপ্নের স্বাদ তার হৃদয়গ্রাহী প্রতিক্রিয়া
আমরা প্রথম পরীক্ষামূলকভাবে ‘মাসুদ তালুকদার’ এর দেওয়া নির্দেশনা মেনে বেসন তৈরি করি এবং নমুনা পাঠাই তাঁর কাছে। তাঁর প্রতিক্রিয়া আমাদের হৃদয়ে আজও ঝংকার তোলে –

“দুর্দান্ত হয়েছে! এমন বেসন বাজারে আর কেউ পাবে না, আমি চ্যালেঞ্জ দিলাম!”

এটা শুধুই প্রশংসা ছিল না! এ যেন আশীর্বাদ, যেন আমাদের মাটির স্বপ্নে তাঁর আঙুল ছুঁয়ে দিলেন আকাশের সাহস। তাঁর অনুপ্রেরণায়, তাঁর অভিজ্ঞতায় ভর করে, আমরা আপনাদের জন্য তৈরি করেছি একদম খাঁটি, নিখুঁত মানের বেসন – যার প্রতিটি দানায় রয়েছে মাটির ঘ্রাণ, মমতার ছোঁয়া, আর রন্ধনশিল্পের নিখাদ সৌন্দর্য।

এই বেসন আমরা তৈরি করেছি নিজস্বভাবে, হাতের নিখাদ ছোঁয়ায়। এই বেসন, এই রন্ধন – এটা শুধুই পণ্য নয়, এক দায়বদ্ধতা।

আমাদের এই বেসনে নেই কোনো রাসায়নিকের ঔদ্ধত্য বা সংরক্ষণের কৃত্রিম ভার। এটি প্রকৃতির নিজস্ব ঘ্রাণ ও রঙে ভরপুর, যা তার স্বতন্ত্র পরিচয় বহন করে। উচ্চমাত্রার প্রোটিন ও ফাইবারে পরিপূর্ণ এই বেসন যেন নিঃশব্দে ছড়িয়ে দেয় পুষ্টির অনুরণন। দেশীয় ঐতিহ্য, নিখাদ যত্ন ও পরম মমতায় তৈরি প্রতিটি দানাই এই বেসনের বিশেষত্ব।

বেসনের সেই রূপ, যা শুধু রান্না নয়, এক অনুভব, যেখানে উপাদানের চেয়ে উদ্দেশ্য বেশি গুরুত্ব পায়, স্বাদের চেয়ে হৃদয়ের সংযোগ বেশি মূল্যবান, আর প্রস্তুতপ্রণালির চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে মূল্যবোধের প্রয়োগ

এই বেসন শুধুমাত্র আপনার রেসিপির স্বাদ বাড়াবে না, আপনাকে ফিরিয়ে নেবে এমন এক পরিশীলিত রান্নার যুগে – যেখানে প্রতিটি উপাদান জেগে থাকে তার নিজস্ব আত্মায়।

আপনার হাতের স্পর্শে জেগে উঠুক স্বাদে ঐতিহ্যে লালিত এক বেসনঃ
যখন আপনি এই বেসন দিয়ে পাকোড়া, পিয়াজু, কিংবা বেগুনি বানাবেন – জেনে রাখুন, আপনি শুধু রান্না করছেন না, আপনি অংশ নিচ্ছেন এক দীর্ঘ, প্রাণবন্ত উত্তরাধিকার ফিরিয়ে আনার পথে। এই বেসন শুধু খাদ্য নয় – এ এক অন্তর্গত সৌন্দর্য, একখণ্ড মাটি, আর এক পশলা ভালোবাসা।

শুধুমাত্র সনাতন ধাঁচে ভেজানো, রোদে শুকানো, ধীরে ধীরে পেষা উপায়ে গড়ে উঠেছে এই বেসন। এটিকে আমরা বলি ‘হেসেলঘরের কাব্য’, যেখানে রান্না কেবল প্রক্রিয়া নয়, রান্নার মধ্য দিয়ে প্রকাশিত হয় আত্মপরিচয়ের এক নিঃশব্দ কাব্যপাঠ। এটাই আমাদের আদর্শ বেসনের গল্প – যার প্রতিটি ধাপে আছে ভালোবাসা, নিষ্ঠা আর খাঁটি এক স্বপ্নের প্রয়াস।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *