এক চিমটি ঘ্রাণ, এক মুঠো শিকড়ঃ
হলুদ, এই একটি মশলা আমাদের প্রতিদিনের খাদ্য-সংস্কৃতির গভীরে গাঁথা। কিন্তু বর্তমান বাজারে হলুদের যত রং, তার ঘ্রাণ ততটাই ম্লান। কৃত্রিম রঙে মোড়ানো, কেমিক্যালে ঢেকে যাওয়া সেই হলুদে নেই মাটির গন্ধ, নেই শিকড়ের গল্প।
গ্রাসরুট ইনিশিয়েটিভ-এর প্রোডাক্ট ইনোভেশন টিম ঠিক এই ঘ্রাণের খোঁজে নামে। তারা খুঁজতে থাকে এমন একটি জায়গা, যেখানে এখনো কেউ হলুদের কন্দ বেছে লাগায়, চাতালে রোদে শুকায়, আর সেই হলুদ নিজেরা শুকিয়ে গুঁড়ো করে। তারা খুঁজছিলো সেই হারিয়ে যাওয়া এক চিমটি ঘ্রাণ, যা সময়কে পেছনে নিয়ে যেতে পারে।
কেন কুরকিউমিন? কেন সেই বিশেষ ঘ্রাণ?
হলুদের আসল গুণ লুকিয়ে থাকে তার ভেতরের উপাদান কুরকিউমিনে। এটি হলুদকে শুধুমাত্র দীপ্ত রং দেয় না, বরং তার গভীর, প্রাকৃতিক ঘ্রাণ ও স্বাস্থ্যগুণের কেন্দ্রবিন্দু করে তোলে। উচ্চমানের কুরকিউমিন মানেই ঘ্রাণে তাজা কাঁচা হলুদের ধাক্কা, মানে এমন একটি আস্বাদ – যেটা খালি চোখে দেখা যায় না, কিন্তু মন ঠিকই বুঝে নেয়।
এই সূত্র ধরেই একদিন পরামর্শ হয় দেশের কৃষি বিশেষজ্ঞদের সাথে। সেখানেই উঠে আসে ঝিনাইদহ জেলার নাম – বিশেষ করে ত্রিবেনী গ্রাম। এখানে নাকি এমন কিছু পুরোনো জাতের হলুদের চাষ হয়, যেখানে কুরকিউমিনের ঘনত্ব দেশের অন্য এলাকার তুলনায় অনেক বেশি।
ত্রিবেনী গ্রামের পথেঃ খাঁটি হলুদের খোঁজে
গ্রাসরুট ইনিশিয়েটিভ-এর টিম পৌঁছায় ত্রিবেনীতে। কুয়াশায় ঢাকা সেই শীতের সকালে গ্রামে ঢুকে তারা পায় কৃষকদের একটি দল, যারা এখনো প্রাচীন হলুদের কন্দকে আগলে রেখেছে।
চাষের পদ্ধতি এখানে আলাদা। রাসায়নিক সার নেই, অতি আধুনিক বীজ নয়। বরং আছে ধৈর্য, জৈব সার, আর পূর্বপুরুষের শিক্ষা। এই হলুদ চাষিরা এখনো জানেন কোন রোদে শুকালে শাঁসের রং ঠিক থাকে, কতটা পানিতে ধুতে হয় যাতে গন্ধ না হারায়। “এই হলুদের রঙ দুর্দান্ত”, বলছিলেন এক প্রবীণ কৃষক, আর এর ঘ্রাণেই আপনি বুঝবেন, মাটি কতটা বলিষ্ঠ।
তারা শুধু ফসল ফলান না, তারা একেকজন ইতিহাসের ধারক। আমাদের টিম তাদের সঙ্গে বসে, শেখে, দেখে, আর আস্তে আস্তে তৈরি হয় একটি নেটওয়ার্ক – একদল হলুদ চাষি, যারা শুধু গ্রাসরুট ইনিশিয়েটিভ-এর জন্য, শুধু খাঁটি মানের হলুদের জন্য কাজ করবেন।
কীভাবে তৈরি হয় এই হলুদের গুঁড়ো?
ত্রিবেনীর মাঠে যখন হলুদ তোলা হয়, তখন তা কুয়াশাভেজা মাটির সঙ্গে আস্তে আস্তে উঠে আসে। এরপর সেই হলুদ রোদে শুকানো হয় – কোনো আধুনিক ড্রায়ার নয়, চাতালে, খোলা আকাশের নিচে। শুকিয়ে গেলে তা নেওয়া হয় গ্রামের ভাঙানোর ঘরে। সেখানে প্রস্তুত হয় গুঁড়া। কেউ কেউ এখনো কাঠের ডিম্বাকৃতি মাড়াই যন্ত্র ব্যবহার করেন – যা একেকটা মশলা বাটার মন্দির যেন।
এভাবে তৈরি হওয়া হলুদের গুঁড়া শুধু মশলা নয়, তা হলো সময়ের ঘ্রাণ। এতে নেই কোনো কৃত্রিম রং, নেই প্রিজারভেটিভ – আছে শুধু মাটির ছোঁয়া, রোদ্দুরের আলসেমি আর মানুষের যত্ন।
শেষে
এই হলুদের গুঁড়া এক চিমটি মশলা নয় – এ এক মুঠো শিকড়। এ এমন এক গন্ধ, যা পুরোনো কাঠের আলমারির ভেতর লুকিয়ে থাকা শাড়ির ভাঁজে পাওয়া যায়। এ এমন এক রং, যা রান্নার হাঁড়িতে পড়ে শুধু স্বাদ বাড়ায় না, ফিরে আনে স্মৃতির আলো।
গ্রাসরুট ইনিশিয়েটিভ এই হলুদে শুধুমাত্র পণ্যের গুণ খোঁজেনি, খুঁজেছে মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক – যেখানে মাটি, মানুষ আর মায়া একসাথে মিশে আছে এক চিমটি ঘ্রাণে।