শুকনো মরিচ গুঁড়ো

রান্না শুধু পেট ভরানোর গল্প নয়, এটি এক নিখুঁত শিল্প। আর সেই শিল্পের অনিবার্য এক কারিগর হলো খাঁটি লাল মরিচের গুঁড়া। তার রং যেন কৃষ্ণচূড়ার পাঁপড়ি ছুঁয়ে ফেরা কোনো বিকেল, আর প্রতিটি গুঁড়ার দানায় লুকিয়ে থাকে মাটির নীরব প্রেম, শীতের রোদের কোমলতা, আর পুরনো দিনের গল্পের গন্ধ। এই মরিচের গুঁড়া যখন হাতে নিই, মনে হয় এটা কেবল এক মশলা নয়, এ যেন মা’র হাতের আচারের বয়ামে লুকিয়ে থাকা শৈশব। প্রতিটি দানার ভেতর থেকে ভেসে আসে এমন এক সুঘ্রাণ, যা চোখ বন্ধ করলেই নিয়ে যায় অন্য এক জগতে – স্মৃতির রোদ ঝলমলে বারান্দায়, যেখানে রান্নাঘরের চিমনির পাশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকতাম গন্ধটা আরেকটু গভীর করে টানতে।

এই ঘ্রাণের পেছনে ছিল আমাদের এক দীর্ঘ, নিবেদিতপ্রাণ যাত্রা। আমরা খুঁজছিলাম এমন এক মরিচ – যার রঙ হবে সূর্যাস্তের মতো উজ্জ্বল, ঝাঁজ হবে মনে দাগ রেখে যাওয়ার মতো, কিন্তু  মুখে আগুন নয়; বরং স্মৃতির জানালা খুলে দেওয়া এক কোমল ঝাপটা। সেই খোঁজে পৌঁছে যাই বগুড়ায় – যমুনা নদীর ধারে নিঃশব্দ এক জনপদে, যেখানে প্রতিটি উঠোন লাল মরিচের পাটি দিয়ে ঢেকে রাখা যেন এক নিঃশব্দ উৎসব। চাতালের নারীরা যেন কবি, যারা প্রতিটি মরিচ বাছাই করেন শুদ্ধতার ছন্দ মেনে, একটুকু দাগ, অমসৃণতা বা রংজ্বলা মরিচের জায়গা সেখানে নেই। আমরা বাছি সেই একেবারে দাগহীন, প্রাণবন্ত, নিখুঁত লাল মরিচগুলো – যারা নিজেরাই নিজেদের গর্ব বহন করে। এটাই আমাদের মরিচকে আলাদা করে তোলে, এবং এর মূল্যও তা-ই বলে, নির্বাক অথচ জোরালো।

তবে কেবল এই লালেই আমরা থেমে থাকিনি। ঘ্রাণের পরিপূর্ণতা খুঁজতে আমরা এক সূক্ষ্ম অথচ সাহসী সংমিশ্রণ ঘটাই ‘তেজা’ মরিচের সঙ্গে। এর ঝাঁজ একটু বেশি, কিন্তু তার গন্ধ যেন ঘরের দরজা খুলে এক লাল পৃথিবী ঢুকে পড়ে ভেতরে। ‘তেজা’র গভীরতা আর সাথে আমাদের আগে খুঁজে আনা লাল মরিচের কোমলতা মিলে গড়ে ওঠে এমন এক সংলাপ, যেখানে মরিচ শুধু ঝাল নয় – স্মৃতি, উষ্ণতা আর ঘরের ছায়াও।

তবে ভালো মরিচ পেলেই তো শেষ নয়, গুঁড়া করাটাও একটি শিল্প। আমাদের কাছে মরিচ ভাঙানো শুধুই যন্ত্রের কাজ নয়, এটা ঠিক তেমনি যত্নের কাজ, যেমন রূপকার তার মূর্তিতে প্রাণ আনেন। মরিচের গুঁড়া করতে হয় সঠিক আর্দ্রতায়। আর্দ্রতা কম হলে রং ম্লান হয়ে যায়, বেশি হলে মিহি গুঁড়া হয় না, স্বাদে পড়ে যায় ছন্দপতন। তাই আমরা সময় নিই, মাপি, বুঝি। প্রতিটি ব্যাচে থাকে ধৈর্য, পরিস্কার করা মেশিন, আর সেই নিখুঁত মুহূর্তের অপেক্ষা – যখন গুঁড়া হবে এমনভাবে, যেন প্রতিটি দানাই বলছে, ‘আমি খাঁটি’, ‘আমি প্রস্তুত’।

এই মিশ্রণ – নদীঘেঁষা জনপদের লাল মরিচ আর তেজার দীপ্তি – আমাদের গোপন সূত্র নয়, বরং আমাদের ভালোবাসার ভাষা। এখানে নেই কোনো কৃত্রিম রং, নেই কেমিক্যালের ছোঁয়া। আছে শুধু দুটি মরিচের গভীর আলাপ – একজন প্রাঞ্জল আর স্নিগ্ধ, আরেকজন তীব্র কিন্তু অভিজাত।এই মরিচের গুঁড়া তাই শুধু রান্নার উপাদান নয়, বরং এক লাল প্রতিজ্ঞা। এর প্রতিটি দানায় আছে মাটির স্পর্শ, নারীর যত্ন, সূর্যের আশীর্বাদ, আর আমাদের অশেষ ভালোবাসা। প্রতিটি রান্না যখন এই গুঁড়ায় ছোঁয়া পায়, তখন তা আর স্রেফ রান্না থাকে না – তা হয়ে ওঠে স্মৃতির এক উনুনে গড়া ছোট্ট উৎসব।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *