ভাল মানের ধনিয়ার গুঁড়া রন্ধনশিল্পের এক অবিচ্ছেদ্য অনুষঙ্গ, যা শুধুই একটি মসলা নয়, বরং প্রতিটি রান্নার স্বাদ, ঘ্রাণ ও রঙে এনে দেয় মন ছুঁয়ে যাওয়ার এক অনন্য মাত্রা। তরকারি, ভাজি, ভুনা কিংবা ঝোল – যেকোনো রান্নায় এটি ব্যবহৃত হলে খাবার হয়ে ওঠে আরও সুস্বাদু ও আকর্ষণীয়। ধনিয়ার গুঁড়ার বিশুদ্ধতা ও তার ঘ্রাণ যেন ঘরের রান্নাঘরে মায়া ছড়িয়ে দেয়। তাই অভিজ্ঞ যেকোনো রাঁধুনির কাছে এটি শুধু একটি উপাদান নয়, বরং একটি আবশ্যক রসদ, যার অনুপস্থিতি রান্নাকে করে তোলে অপূর্ণ। ধনিয়া মসলা শুধু স্বাদ ও ঘ্রাণ বাড়ায় না, এটি স্বাস্থ্যের জন্যও অত্যন্ত উপকারী। রান্নায় ধনিয়া ব্যবহার করলে খাবারে আসে অনন্য সুগন্ধ, যা খাওয়ার রুচি বাড়ায় এবং খাবারকে করে তোলে অধিক উপভোগ্য। পাশাপাশি, ধনিয়াতে রয়েছে হজমশক্তি বাড়ানোর গুণ, যা খাবার খাওয়ার পর অস্বস্তি বা গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা কমাতে সাহায্য করে। এতে থাকা প্রাকৃতিক অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ও অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল উপাদান শরীরকে করে সতেজ এবং রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। অনেক রাঁধুনির কাছে ধনিয়া এক রহস্যময় মসলা, যা অল্প পরিমাণের ব্যবহারই পুরো রান্নার স্বাদ বদলে দিতে সক্ষম।
তবে আমরা প্রায় সবাই রান্নাতে ধনিয়ার গুঁড়া ব্যবহার করলেও, অনেকেই জানি না কোন ধরণের ধনিয়া সবচেয়ে ভালো, কোথায় এটি উৎকৃষ্টভাবে উৎপাদিত হয় কিংবা আদর্শ উপায়ে কীভাবে এর গুঁড়া প্রস্তুত করা যায়। এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজতে গিয়ে গ্রাসরুটস ইনিশিয়েটিভ’এর প্রোডাক্ট ইনোভেশন টিম শুরু করে একটি গভীর অনুসন্ধান। তাঁরা বিশ্লেষণ করতে থাকেন ধনিয়ার জাতভেদ, উৎপাদনের ভৌগোলিক পার্থক্য এবং গুঁড়া তৈরির সর্বোত্তম প্রক্রিয়া – যার লক্ষ্য একটাই, ভোক্তাদের কাছে পৌঁছে দেওয়া সর্বোচ্চ মানের, সুগন্ধী ও খাঁটি ধনিয়ার গুঁড়া।
বিভিন্ন নথিপত্র ঘেটে, অভিজ্ঞ কৃষি বিশারদদের বয়ান এবং মাঠ পর্যায়ে কৃষকদের মতামতের আলোকে জানা যায়, পাবনা জেলার পদ্মা ও যমুনা নদীবিধৌত অঞ্চলগুলোতে উৎকৃষ্ট মানের ধনিয়া উৎপন্ন হয়। এই তথ্য পাওয়ার পরই আমরা ছুটে যাই সেইসব জনপদে। কয়েকদিন অবস্থান করে স্থানীয় কৃষকদের সঙ্গে কথা বলি, তাদের অভিজ্ঞতা শুনি, আর কাছ থেকে চিনে নিতে চেষ্টা করি সেই খাঁটি ধনিয়া, যার সুবাসেই যেন মাটির গন্ধ মিশে থাকে।
সেখানকার কৃষকরা জানান, উৎকৃষ্ট মানের ধনিয়া চাষে যতটা না কষ্ট, তার চেয়ে বেশি পরিশ্রম জড়িত এর প্রক্রিয়াজাতকরণ ও সংরক্ষণে। সর্বোত্তম মানের ধনিয়া পেতে হলে অনেক সময় ফলনও কমে যায়। কারণ, এই ধনিয়া তুলতে হয় একটু আগেভাগেই, যখন দানা সবুজাভ ও মোটা থাকে। এর ফলে বিঘা প্রতি প্রায় এক মণ কম ফলন পাওয়া যায়, যা কৃষকদের আর্থিক ঝুঁকি বাড়িয়ে তোলে।
তবে যতই পরিশ্রমসাধ্য হোক, প্রকৃত উৎকৃষ্ট ধনিয়ার জন্য প্রয়োজন নিখুঁত প্রক্রিয়াকরণ। প্রথমে ক্ষেত থেকে তুলে তা ভালোভাবে ধুয়ে পরিষ্কার করতে হয়। এরপর সূক্ষ্ম নেটের কাপড়ে নির্দিষ্ট মাত্রার আর্দ্রতায় রোদে শুকাতে হয়। একটু এদিক-সেদিক হলেই সমস্যা – বেশি শুকালে সবুজাভ রং হারিয়ে যায়, গন্ধও নিস্তেজ হয়ে পড়ে; আবার কম শুকালে কিংবা অল্প ভেজা থাকলে দানা কালো হয়ে যায় এবং সহজেই ভেঙে যায়, ফলে বাজারে দাম পড়ে যায় একেবারে তলানিতে।
এই সব কারণেই এমন মানসম্পন্ন ধনিয়ার চাষ ও প্রক্রিয়াকরণ অনেক কঠিন এবং পরিশ্রমসাধ্য একটি কাজ। যদিও এর বাজারমূল্য অপেক্ষাকৃত বেশি, তবু অনেক কৃষক আগেভাগে তুলতে চান না, কারণ উৎপাদন কম এবং ঝুঁকি অনেক বেশি। বেশিরভাগ কৃষক অপেক্ষা করেন, ধনিয়া একটু পরিপক্ব হলেই তা সংগ্রহের জন্য। সবুজাভ ধনিয়ার দাম তুলনামূলকভাবে বেশি হলেও, বাজারে এর চাহিদা অনেক সময় ততটা থাকে না। কারণ, উচ্চমূল্যের পণ্যের জন্য নিয়মিত ক্রেতা পাওয়া সহজ নয়। অভিজ্ঞ কৃষকেরা জানান, এই ধরনের ধনিয়া কেনেন মূলত সেই মানুষরাই, যারা প্রজন্ম ধরে নিজেরাই ধনিয়ার গুঁড়া করে ব্যবহার করে আসছেন। এরা জানেন, এই সবুজাভ, পরিপক্ক ধনিয়ার মধ্যে রয়েছে এক গভীর, স্থায়ী ঘ্রাণ এবং স্বাদ, যা যেকোনো রান্নাকে নিয়ে যায় অন্য মাত্রায়।
তাছাড়া কিছু মুদি দোকানদারও এই ধনিয়া সংগ্রহ করেন। তারা আস্ত দানা আকারে বিক্রি করেন,অল্প করে, মেপে মেপে, যেন প্রতিটি পরিবারের হেঁশেলে পৌঁছে যায় এই মসলার বিশুদ্ধতা। এমন অনেক রাঁধুনি আছেন, যারা রান্নার সময় সরাসরি আস্ত ধনিয়া দিয়ে থাকেন, শুধুমাত্র স্বাদ বাড়ানোর জন্য নয়, বরং একটুকরো ঘ্রাণে তাঁদের রান্নার সজীবতা বাড়ানোর জন্য।
এরপরেও ধনিয়ার নানা রকম প্রকারভেদ রয়েছে। যেগুলোর দানা ভাঙ্গা কম এবং সবুজাভ ভাব কম অর্থাৎ পরিপক্ক হওয়ার পর তোলা হয়েছে সেগুলোর দাম আরেকটু কম। এই ধনিয়াটি বাজারে আসলে এক নম্বর ধনিয়া হিসেবে ব্যবহার ও বিক্রি করা হয়। কিন্তু আমরা অভিজ্ঞ, সৎ ও পরিশ্রমী কৃষকদের সাথে কথা বলে এখন জানি এর উপরেও সর্বোচ্চ উৎকৃষ্ট ধনিয়া রয়েছে যেগুলো আমরা সংগ্রহ করছি, সেই ধনিয়া তোলা হয় একটু আগেভাগে, যখন দানা মোটা, সবুজাভ এবং ঘ্রাণে ভরপুর থাকে। এই ধনিয়াই ব্যবহার করেন অভিজ্ঞ রাঁধুনি আর ভোজনরসিক মানুষরা, যারা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে জানেন কোন ধনিয়া আসলে সেরা।
কিন্তু ধনিয়ার গল্প এখানেই শেষ নয়। ধনিয়ার গুঁড়া তৈরির ক্ষেত্রে আমরা সম্মান জানিয়েছি স্থানীয় মানুষের অমূল্য অভিজ্ঞতা, তাদের প্রজন্মান্তরে বয়ে আসা জ্ঞান, এবং ক্ষেত্রভিত্তিক বাস্তবতা। ধনিয়ায় কতটুকু রোস্টিং দরকার, কতটা সূক্ষ্মভাবে গুঁড়া করলে তার স্বাদ আর ঘ্রাণ যেন হারিয়ে না যায়, এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে আমরা কৃষক ও অভিজ্ঞ রাঁধুনিদের কাছে বার বার ফিরে গেছি। কারণ, ভালো ধনিয়ার গুঁড়া মানে কেবল ভালো কাঁচামাল নয়, তার সঠিক প্রক্রিয়াজাতকরণও জরুরি।
তাই আমরা শুধু উৎকৃষ্ট ধনিয়াই বেছে নিইনি, বরং এই গুঁড়ার মধ্যে এমন এক মিশেল তৈরি করেছি যেখানে স্বাদ, গন্ধ এবং পুষ্টির সাথে জড়িয়ে আছে ঐতিহ্যের এক অমূল্য গল্প। আমরা যোগ করেছি নির্দিষ্ট অনুপাতে দারুচিনি, এলাচ এবং সুগন্ধযুক্ত ছোট ধনিয়া যাকে স্থানীয়ভাবে গুঁড়া সজ বা রাঁধুনি বলে – যেগুলোর দাম হয়তো বেশি, তবে আমরা কখনোই বিশুদ্ধতা, স্বাদ, সুঘ্রাণ ও ঐতিহ্যকে অন্য কোন কিছুর সাথে আপোষ করি নি। কারণ, খাঁটি ধনিয়ার গুঁড়া একেকটা ইতিহাস, একেকটা স্মৃতি; যা প্রতিটি রান্নায় এনে দেয় সজীবতা, এক অপূর্ব অনুভূতি।
এই গুঁড়া আমাদের কাছে শুধুই মসলার উপাদান নয়, এটি এক আধ্যাত্মিক যাত্রা, যেখানে কৃষকের হাতের মায়া, রাঁধুনীর আবেগ এবং আমাদের ভালোবাসা মিলে সৃষ্টি করেছে বাজারের সবচেয়ে উৎকৃষ্ট মানের ধনিয়ার গুঁড়া।